কম্পিউটারের জনক কে : যাদের কল্পনা ও আবিষ্কার বদলে দিল বিশ্ব। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এই ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা সুপার কম্পিউটারের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি? কম্পিউটারের জনক বলা হয় কাকে? কম্পিউটারের জনক কে ? উত্তরটা এক কথায় দেওয়া কঠিন, কারণ কম্পিউটারের ইতিহাস একাধিক মেধাবী মানুষের স্বপ্ন, পরিশ্রম এবং বৈপ্লবিক আবিষ্কারের গল্পে ভরা।তবে এই গল্পের শুরুটা হয়েছিল প্রায় ২০০ বছর আগে, একজন ব্রিটিশ গণিতবিদের হাত ধরে যার নাম চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage)। চলুন, সময় মেশিনে চড়ে ঘুরে আসি কম্পিউটিংয়ের জন্মকথা থেকে।
কম্পিউটারের জনক কে ?
চার্লস ব্যাবেজ: যিনি কল্পনা করেছিলেন যন্ত্রের মস্তিষ্ক
একটি যন্ত্র কি গণনার কাজ মানুষের চেয়ে নির্ভুলভাবে করতে পারে? ১৮০০ এর দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই চার্লস ব্যাবেজ তৈরি করেছিলেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন (Difference Engine) এবং অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন (Analytical Engine) এর নকশা। যদিও তার জীবদ্দশায় এই যন্ত্রগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, তবুও এই ধারণা গুলোই ছিল আধুনিক কম্পিউটারের বীজ।
কী ছিল চার্লস ব্যাবেজের উদ্ভাবনে?
ডিফারেন্স ইঞ্জিন (১৮২২): এটি ছিল একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর, যা পলিনোমিয়াল সমীকরণ (যেমন: লগারিদম) স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণনা করতে পারত। ব্যাবেজের লক্ষ্য ছিল মানবীয় ভুল দূর করে বৈজ্ঞানিক গণনাকে আরো নির্ভরযোগ্য করা।
অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন (১৮৩৭): এটি ছিল বিশ্বের প্রথম জেনারেল-পারপাস কম্পিউটার এর নকশা! এতে ছিল ইনপুট/আউটপুট ডিভাইস, মেমরি (ব্যাবেজ যাকে বলতেন স্টোর) এবং প্রসেসিং ইউনিট (মিল)। এটি কার্ডের মাধ্যমে প্রোগ্রাম করা যেত যা আজকের প্রোগ্রামেবল কম্পিউটারের সরাসরি পূর্বসূরি।
কেন ব্যাবেজকে কম্পিউটারের জনক বলা হয়?
ব্যাবেজের অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনে আধুনিক কম্পিউটারের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ছিল:
১. প্রোগ্রামেবিলিটি: পাঞ্চ কার্ড ব্যবহার করে নির্দেশনা দেওয়া যেত।
২. শর্তসাপেক্ষ শাখাবিন্যাস (Conditional Branching): if-else লজিকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।
৩. লুপ: একটি কাজ বারবার করার ব্যবস্থা।
তবে দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই যুগের প্রযুক্তি ও অর্থ সংকটের কারণে ব্যাবেজের যন্ত্রটি নির্মাণ সম্ভব হয়নি। তবুও, তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানের দারুণ ভিত্তি তৈরি করে গিয়েছিলেন।
অ্যাডা লাভলেস: বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার
চার্লস ব্যাবেজের স্বপ্নকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক প্রতিভা অ্যাডা লাভলেস (Ada Lovelace)। গণিতের প্রতি তার অসাধারণ মেধা এবং ব্যাবেজের সাথে বন্ধুত্ব তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে।
অ্যাডার যুগান্তকারী অবদান
১৮৪৩ সালে, তিনি ইতালীয় গণিতজ্ঞ লুইজি মেনাব্রেয়ার একটি ফরাসি নিবন্ধ অনুবাদ করেন এবং তার সাথে টীকা (notes) যোগ করেন, যা মূল নিবন্ধের চেয়েও তিনগুণ দীর্ঘ ছিল!
এই টীকায় তিনি বের্নুলি সংখ্যা গণনার জন্য অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের একটি অ্যালগরিদম লিখেন যাকে বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে কম্পিউটার শুধু সংখ্যা গণনা নয়, সংগীত রচনা বা গ্রাফিক্স ডিজাইনের মতো সৃজনশীল কাজেও ব্যবহার হতে পারে।
প্রোগ্রামিং ভাষা অ্যাডা এর নামকরণ
১৯৮০ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ একটি প্রোগ্রামিং ভাষার নাম দেয় অ্যাডা, তার সম্মানে। অ্যাডা লাভলেসকে তাই আজও স্মরণ করা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর জননী হিসেবে।
অ্যালান টুরিং: যিনি কম্পিউটারের তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন
১৯৩০-৪০ এর দশকে, অ্যালান টুরিং (Alan Turing) কম্পিউটিং এর ধারণাকে এক নতুন মাত্রা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান এনিগমা কোড ভাঙার জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন বোম্ব মেশিন যা প্রথম ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কম্পিউটার গুলোর মধ্যে একটি।
টুরিং মেশিন: কম্পিউটিংয়ের তাত্ত্বিক মডেল
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত তার গবেষণাপত্র On Computable Numbers এ তিনি টুরিং মেশিন এর ধারণা দেন একটি কাল্পনিক যন্ত্র যা যেকোনো অ্যালগরিদমিক সমস্যা সমাধান করতে পারে। এই তত্ত্বই আধুনিক কম্পিউটারের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের ভিত্তি তৈরি করে।
টুরিং টেস্ট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
টুরিং প্রস্তাব করেছিলেন যে যদি একটি মেশিন মানুষের সাথে কথোপকথন করে তাকে বোঝাতে পারে যে সে মানুষ, তাহলে তা বুদ্ধিমান বলে গণ্য হবে। এই টুরিং টেস্ট আজও AI গবেষণার মাইলফলক।
জন ভন নিউম্যান: আধুনিক কম্পিউটার আর্কি টেকচারের জনক
১৯৪০ এর দশকে, হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানী জন ভন নিউম্যান (John von Neumann) কম্পিউটার ডিজাইনে বিপ্লব ঘটান। তার প্রস্তাবিত ভন নিউম্যান আর্কিটেকচার আজকের প্রায় সব কম্পিউটারের মূল নকশা।
ভন নিউম্যান আর্কিটেকচারের বৈশিষ্ট্য
১. প্রোগ্রাম ও ডেটা একই মেমরিতে সংরক্ষণ: আগে যন্ত্রগুলো নির্দিষ্ট কাজের জন্য ওয়্যার্ড হতো, কিন্তু এই ডিজাইনের ফলে কম্পিউটার বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালাতে পারত।
২. সিপিইউ, মেমরি এবং ইনপুট/আউটপুট ইউনিটের বিভাজন: এই কাঠামো এখনও ব্যবহৃত হয়।
ENIAC এবং EDVAC
ভন নিউম্যান ENIAC (প্রথম ইলেকট্রনিক জেনারেল-পারপাস কম্পিউটার) এবং EDVAC প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। EDVAC ছিল প্রথম কম্পিউটার যেখানে ভন নিউম্যান আর্কিটেকচার প্রয়োগ করা হয়েছিল।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারীরা
- গ্রেস হপার (Grace Hopper): প্রথম কম্পাইলার উদ্ভাবন এবং COBOL ভাষার উন্নয়ন।
- কনরাড জুস (Konrad Zuse): ১৯৪১ সালে জার্মানিতে প্রথম প্রোগ্রামেবল ইলেকট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার Z3 তৈরি।
- ক্লদ শ্যানন (Claude Shannon): ডিজিটাল সার্কিট ডিজাইনের তত্ত্ব প্রদান।
শেষকথা
কম্পিউটারের জনক বলা হয় চার্লস ব্যাবেজকে, কারণ তিনিই প্রথম এমন একটি যন্ত্রের ধারণা দিয়েছিলেন যা আধুনিক কম্পিউটারের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। তবে, অ্যাডা লাভলেস, অ্যালান টুরিং, জন ভন নিউম্যান এবং আরো অনেকে এই যাত্রাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। কম্পিউটিংয়ের ইতিহাস শুধু একজন মানুষের নয় এটি বহু মেধার সম্মিলিত বিজয়।
আজ আমরা যে ডিজিটাল যুগে বাস করছি, তা সম্ভব হয়েছে এই মহান উদ্ভাবকদের কল্পনা, অধ্যবসায় এবং দূরদর্শিতার কারণে। তাই, কম্পিউটারের জনক কে? এই প্রশ্নের উত্তর এক নামে সীমিত নয় বরং এটি একটি অনন্ত অনুসন্ধানের গল্প, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ে যোগ হয়েছে নতুন এক বিপ্লব।
Source: Online